খালাস পেয়েও ১৬ বছর জেল খেটেছেন ফিরোজ মিয়া, এখন তিনি সংসারের বোঝা

১৬ বছরে অনেক কিছু হারিয়েছি। ৫ বছরের শিশু সানজিদকে রেখে কারাগারে গিয়েছিলাম, আজ সে অনেক বড় হয়েছে। আট বছরের মেয়েকে রেখে গিয়েছিলাম, আজ তার নিজের ঘরেও সন্তান আছে। জীবনের সোনালী সময়টা চার দেওয়ালের ভেতর কেটেছে। সুখ কি জিনিস, তা চোখে দেখিনি। এখন বয়স ৫৯ বছর, কোনো আয় নেই। ১৬ বছর জেল খেটে এখন আমি সংসারের বোঝা হয়ে গেছি।’

কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় জামিন পাওয়া বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সাবেক নায়েক নোয়াখালীর ফিরোজ মিয়া। তিনি কবিরহাট উপজেলার নরোত্তমপুর ইউনিয়নের করমবক্স এলাকার পদুমা গ্রামের মৃত আব্দুল হাইয়ের ছেলে।

জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাগলা জিম মাঠে কাজ করছিলেন ফিরোজ মিয়া। হঠাৎ শব্দ ও মানুষের ছোটাছুটি দেখে তিনি পার্শ্ববর্তী ভবনে আশ্রয় নেন। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস চাকরি করেন। একই বছর নভেম্বরে মিথ্যা সাক্ষী না দেওয়ায় তাকে জেলে প্রেরণ করা হয়। ২০১৩ সালে হত্যা মামলার রায়ে খালাস পান ফিরোজ মিয়া। তবে তাকে জেল খাটতে হয় আরও ১২ বছর। সব মিলিয়ে কারাগারেই কেটে যায় জীবনের মূল্যবান ১৬টি বছর।

সরেজমিনে ফিরোজ মিয়ার বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, দীর্ঘ বছর পর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফেরায় গ্রামজুড়ে আনন্দের জোয়ার বইছে। দূর-দূরান্ত থেকে স্বজনরা ছুটে এসেছেন ফিরোজের সঙ্গে দেখা করতে। ১৬ বছর পর স্ত্রী-সন্তানকে কাছে পেয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরছে ফিরোজের চোখে। ছেলেকে নিয়ে স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরে দেখেন তিনি, মায়ের কবরেও যান। তবে মুক্ত বাতাসেও ফিরোজ মিয়ার চোখে-মুখে অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

ফিরোজ মিয়ার ছেলে ফজলুর রহমান সানজিদ বলেন, ‘স্কুলে যেতাম, সবার বাবাকে দেখতাম, কিন্তু আমার বাবাকে কখনো দেখিনি। ১৬ বছর বাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। বাবাকে কতটা ভালোবাসি, তা বলতে পারব না। আমার বাবার হারানো ১৬ বছর কেউ ফেরত দিতে পারবে না। কিন্তু মিথ্যা অপবাদ দিয়ে এভাবে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তার সঙ্গে বৈষম্য হয়েছে। তার সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া হোক, সেটাই চাই।’

ফিরোজ মিয়ার স্ত্রী নাজমুন নাহার বলেন, ‘ছোট ছেলে-মেয়েকে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করিয়েছি। স্কুলে যাওয়ার সময় খাবার দিতে পারিনি। ছেলে-মেয়ে তাদের বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ১৬ বছর পর স্বামীকে কাছে পেয়ে দুঃখগুলো আরও বেড়ে গেছে। সামনের দিনগুলো কিভাবে চলব, জানি না। আমি চাই, আমার স্বামীর সব ন্যায্য পাওনা সরকার বুঝিয়ে দিক।’

নিজেকে সংসারের বোঝা দাবি করে ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘ছোট ছেলে-মেয়ে রেখে কারাগারে গিয়েছি। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর ৯ মাস পর্যন্ত চাকরি করেছি। ২০১৩ সালে খালাস পাওয়ার পরও আমাকে কারাগারে থাকতে হলো। আমার তো কোনো দোষ ছিল না। আমি মিথ্যা সাক্ষী দেইনি, তাই আমাকে ১৬ বছর কারাগারে থাকতে হলো। এখন কিছুই করতে পারি না। সারাক্ষণ সন্তানদের দেখে কান্না চলে আসে। আমার কিছুই নেই, আমি সংসারের বোঝা। সরকারের কাছে চাকরি পুনর্বহাল, মামলা থেকে অব্যাহতি এবং ১৬ বছরের পাওনা দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’

ফিরোজ মিয়াকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বিডিআর কল্যাণ পরিষদ নোয়াখালী শাখার তার সহকর্মীরা। তাদের একজন বিডিআরের সাবেক নায়েক মো. নুরুল হোসেন লিটন বলেন, ‘১৬ বছর কারাভোগের পর একটা মানুষের জীবনে আর কিছুই থাকে না। ৫৯ বছরের ফিরোজ মিয়া কোথাও চাকরিও করতে পারবে না। সে এখন সমাজের বোঝা হয়ে গেছে। নিজের জন্য কিছুই নেই, যা সে সন্তানদের দেবে। কান্নাকাটি করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই।’

আরেক সহকর্মী ল্যান্স নায়েক মানিক হোসেন বলেন, ‘কারাবন্দি ১৬ বছর মানে জীবনের অর্ধেক শেষ। আমি নিজেও ৫ বছর কারাবন্দি ছিলাম। আমরা আজ অনেক আনন্দিত, দীর্ঘদিন পর হলেও আমাদের এক সদস্যকে দেখতে পেয়েছি। তবে আমাদের দাবি, ফিরোজ মিয়ার ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হোক। এছাড়া, অতিদ্রুত বাকিদেরও মুক্তি দেওয়া হোক এবং আসল অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হোক।’

শেয়ার করুন

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *