দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট কে এই হান

-দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদে আইনপ্রণেতাদের ভোটাভুটিতে অভিশংসিত হয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল। শনিবার সংসদে দ্বিতীয় দফার ভোটে অভিশংসিত হয়েছেন তিনি। ইউন সুক-ইওল অভিশংসিত হওয়ায় এখন দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন প্রধানমন্ত্রী হ্যান ডাক-সু।

টেকনোক্র্যাট হিসেবে রাজনীতিতে পদার্পন করা প্রধানমন্ত্রী হ্যানের বেশ সুনাম রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। তার দক্ষতা আর ব্যাপক অভিজ্ঞতা নতুন দায়িত্ব পালনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত সপ্তাহে একেবারে আকস্মিকভাবে সামরিক আইন জারি করার সাময়িক প্রচেষ্টার পর ইউনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অভিশংসন প্রস্তাব পাস হওয়ায় সাংবিধানিকভাবে তার প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা স্থগিত হয়ে গেছে। সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির প্রধানমন্ত্রী এখন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে ব্যাপক বিভক্তি আর বাগাড়ম্বরের মাঝে দেশটিতে হ্যানকে একজন বিরল কর্মকর্তা হিসেবে মনে করা হয়; যার বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন দলীয় সীমা ছাড়িয়ে গেছে। দেশটির গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে সরকারি কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার মতো চ্যালেঞ্জিং কাজের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার হুমকি ও দেশের ধীরগতির অর্থনৈতিক সংকটও মোকাবিলা করতে হবে তাকে।

তবে অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউনের সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিয়েও ফৌজদারি তদন্ত চলছে। যে কারণে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে হ্যানেরও মেয়াদ হুমকির মুখে পড়তে পারে। ৭৫ বছর বয়সী হ্যান দেশটির রক্ষণশীল ও উদারপন্থী পাঁচজন ভিন্ন ভিন্ন প্রেসিডেন্টের অধীনে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনসহ দেশের অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টের নীতি সমন্বয়বিষয়ক সচিব, প্রধানমন্ত্রী, ওসিইডির রাষ্ট্রদূত এবং বিভিন্ন থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া হ্যানের অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং কূটনীতিতে ব্যাপক দক্ষতা রয়েছে। এর পাশাপাশি অত্যন্ত যৌক্তিক ও মধ্যপন্থী আচরণ ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে খ্যাতি রয়েছে। যা তাকে দেশটির রাজনীতিতে অনিবার্য করে তুলেছে।

এর আগে, ২০২২ সালে ইউনের মেয়াদ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন হ্যান। এর আগে, ২০০৭-২০০৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু-হিউনের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

২০২২ সালে হ্যানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করার সময় ইউন বলেছিলেন, ‘‘তিনি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন কেবল দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার বলে; রাজনৈতিক দলাদলির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই তার।’’

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে হ্যানের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়ায় ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি।

ইংরেজিতে বেশ দক্ষ হ্যান ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি এমন সময়ে ওয়াশিংটনে কাজ করেছিলেন; যখন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার বহুল আলোচিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অনুমোদনে ক্ষেত্রে কংগ্রেসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

সৌদি আরবের জায়ান্ট তেল কোম্পানি আরামকোর দক্ষিণ কোরিয়ার পরিশোধন শাখা এস-অয়েলের বোর্ড সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

• ইউনকে অভিশংসনের নেপথ্যে
গত ৩ ডিসেম্বর উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট শক্তির হুমকি থেকে মুক্ত কোরিয়া প্রজাতন্ত্র রক্ষা, জনগণের স্বাধীনতা ও সুখ লুণ্ঠনকারী ঘৃণ্য উত্তর কোরিয়াপন্থী রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিগুলোকে নির্মূল এবং উদার সাংবিধানিক সুরক্ষার ঘোষণা দিয়ে হঠাৎ করে দেশজুড়ে সামরিক আইন জারি করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল।

যদিও বিরোধীদের তীব্র আপত্তি ও সংসদে ভোটাভুটির পর মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে সেই সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। পরে দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আদালত। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দায়ের করা মামলার তদন্ত চলমান আছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট ইউনের নিযুক্ত করা দেশটির প্রধানমন্ত্রী হ্যান ডাক-সু এখন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন। সংসদে অভিশংসিত হলেও জটিল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট পদে থাকবেন ইউন। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনও নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে না তার।

প্রধানমন্ত্রী হ্যান ডাক-সু বলেছেন, ইউনের অভিশংসনের পর দেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন তিনি। বলেন, ‘‘আমি সরকারকে স্থিতিশীল করার জন্য আমার সমস্ত শক্তি এবং প্রচেষ্টাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবো।’’

দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদে অভিশংসিত হয়েছেন ইউন। এর আগে, ২০১৭ সালে দেশটির রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হেকে অভিশংসিত করেন সংসদ সদস্যরা।

সামরিক আইন জারি ঘিরে গত সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদে প্রেসিডেন্ট ইউনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিশংসনের প্রচেষ্টা চালান বিরোধীরা। তবে সামান্য ভোটের ব্যবধানে সেই দফায় বেঁচে যান তিনি। ওই সময় তার রাজনৈতিক দল ভোট বয়কট করায় অভিশংসনের পক্ষে সংসদে বিরোধীদের কোরাম করা সম্ভব হয়নি।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ইউনের পিপল পাওয়ার পার্টির অন্তত ১২ জন আইনপ্রণেতা বিরোধী শিবিরে যোগ দেওয়ার পর শনিবার দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদে অভিশংসন প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের ১৯২ আসনে নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয়। যা অভিশংসনের জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের পথ পরিষ্কার করে।

শনিবার সংসদে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন মোট ২০৪ জন আইনপ্রণেতা। বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ৮৫ জন। এছাড়া তিনজন আইনপ্রণেতা সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন এবং আটটি ভোটকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।-

শেয়ার করুন

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *